প্রতিদিনের মতো সুইং অপারেটর নীলুফা (৪৬) ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বুধবার কাজের জন্য যান রানা প্লাজায়। ভবনধসের পরে তাঁর দুই পায়ে দুটি লাশ এবং তাঁর ওপরে ভবনের ছাদ চাপা অবস্থায় আটকে থাকেন প্রায় ৯ ঘণ্টা। পায়ের অনুভূতি হারিয়ে তাঁর দুই পা-ই বেঁকে যায়। পায়ের চিকিৎসার জন্য শুরুর দিকে সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পেলেও, পরে নিজের খরচে প্রায় ১১ বার অপারেশন করান। ২০১৪ সালে আইএলওর মাধ্যমে প্রতিষ্� িত রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন, অথচ তাঁর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
১১ বছর পরেও এখনো পুরোপুরি হাঁটতে পারেন না ৪৬ বছর বয়সী নীলুফা, ব্র্যাক থেকে পাওয়া বিশেষ জুতার সাহায্যে হাঁটেন। ডাক্তার বলেছেন, পায়ের আরও একটি অপারেশন দরকার, যা দেশের বাইরে গিয়ে করাতে হবে। অর্থের অভাবে তিনি এই চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
নীলুফা কিছুদিন আগে একটি কর্মশালায় জানান, বর্তমানে তিনি ব্রেস্ট ক্যানসার, ব্রেন টিউমার এবং মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যায়ও ভুগছেন। রানা প্লাজা ধসের পরে স্বামী তাঁকে ও একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে চলে যান। চিকিৎসার পাশাপাশি ছেলের ভরণপোষণ বহন করা নীলুফার জন্য কষ্টসাধ্য হওয়ায় ছেলেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে কাজে পা� িয়ে দেন। ১৬ বছরের ছেলে ড্রাইভিং শিখছে এবং নীলুফা নিজে একটি ছোট্ট পানের দোকান দিয়েছেন। কর্মশালায় তিনি দাবি করেন, ‘সরকার আমাগো আইনি ক্ষতিপূরণটা দিক, দুইবেলার খাবার জোগাড় করতে না পারলেও যাতে একবেলার ভাত কপালে জোটে, আমাগো মতো শ্রমিকদের পুনর্বাসন কইরা দিক আর নিহত শ্রমিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি কইরা দিক।’
রানা প্লাজার আরেক শ্রমিক শিলা বেগমের (৪৫) মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায় ভবনের বিমের নিচে চাপা পড়ে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার কারণে। পি� ে বেল্ট পরা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। এ ছাড়া তাঁর পেটে টিউমার হয়েছে, যা থেকে প্রায় সময় রক্তক্ষরণ হয়। সরকারিভাবে তিনি চিকিৎসা পেলেও এ সেবাটি খুবই সময়সাপেক্ষ এবং অনুন্নত। শিলার কর্মক্ষমতা না থাকার কারণে সবার কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে দিনাতিপাত হয়। নীলুফা ও শিলা উভয়েই সুইং অপারেটর হিসেবে ওভারটাইমসহ মাসে ১৩-১৪ হাজার টাকা আয় করতেন।
নীলুফা ও শিলার মতো আরও ১ হাজার ১৬৯ জন শ্রমিক ভবনধসের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাকশিল্পের অনেক শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় আহত এবং প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন উন্নত চিকিৎসা এবং স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে একজন মানুষের জীবনের সমস্ত মানবসৃষ্ট বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনসেবা রানা প্লাজাসহ অন্যান্য ঘটনায় আহত শ্রমিকদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিতে কতটুকু সচেষ্ট, তা বিবেচনায় আনা জরুরি। বিভিন্ন বিপর্যয়ে আহত শ্রমিকদের যথাযথ এবং উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিদ্যমান হাসপাতালগুলোয় বিশেষ ওয়ার্ড কিংবা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ঘণ্টার ব্যবস্থা নেই; ফলে অনেক শ্রমিক পঙ্গুত্ব নিয়েই জীবনযাপন করছেন।
২০১৩ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রানা প্লাজায় নিহত এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করার জন্য সরকারি উচ্চপর্যায়ে কমিটি গ� ন করা হয়। কমিটি আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিনা খরচে সার্বিক চিকিৎসা দেওয়া এবং যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, তাঁদের আজীবন সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে কৃত্রিম অঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধা পাওয়ার জন্য স্থায়ী কার্ডের সুপারিশ করে, যা আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।
এ ছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৬০ ধারায় যেকোনো কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষের সেবা নিশ্চিত করা এবং মালিক শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনাজনিত বিমা স্কিম চালু ও বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়। এই ধারার প্রয়োগ বাস্তব জীবনে কতটুকু প্রতিফলিত হয় তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও সম্প্রতি তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ১৫০টি ফ্যাক্টরিতে এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিমের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা সফল হলে পরে এ খাতে স্কিমটি ব্যবহার করা হবে। যেহেতু এ স্কিমটি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, তাই নিকট ভবিষ্যতে এর বাস্তবায়নের আশা খুবই ক্ষীণ।
ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস রানা প্লাজায় আহত ২০০ শ্রমিক পরিবারকে নিয়ে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, রানা প্লাজার ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বেকারত্ব, পরিবারের জীবন-জীবিকার তাগিদ এবং চিকিৎসার খরচ নিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। ক্ষতিগ্রস্ত এই শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য দরকারি প্রাতিষ্� ানিক সহায়তা এবং তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন অনুযায়ী, মৌলিক চাহিদা পূরণ-সম্পর্কিত কোনো তথ্যভান্ডার বা ম্যাপিং করা হয়নি।
আহত শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ঘণ্টার ব্যবস্থা করা উচিত, যার মাধ্যমে শ্রমিকেরা সব ধরনের জরুরি এবং দীর্ঘমেয়াদি সেবা পেতে পারেন। অঙ্গহানি হওয়া শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী কার্ড প্রদান করা জরুরি, যাতে কৃত্রিম অঙ্গ পেতে তাঁরা কোনো ধরনের বিলম্বের সম্মুখীন না হন। রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো দুর্বিষহ পরিস্থিতি এড়াতে, সব কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত বিমা স্কিম নিশ্চিত করা দরকার। শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে আহত ও নিহত শ্রমিকের পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ ধরনের বিপর্যয়ের তথ্যগুলোর সমন্বয়ে সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়নে একটি তথ্যভান্ডার করা উচিত, যাতে করে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে সর্বসাধারণ জানতে পারেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেন। বিভিন্ন সুশীল সমাজের কার্যক্রমের পাশাপাশি নীলুফা ও শিলাদের মতো শ্রমিকদের একটি স্বাভাবিক জীবন এবং মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।