আফরিদা সামিহা নাবিলাহ্, রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট, ব্লাস্ট
মনীষা বিশ্বাস, সিনিয়র অফিসার, লিগ্যাল অ্যান্ড রিসার্চ, ব্লাস্ট
Originally posted in আজকের পত্রিকা on 13th June 2024
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি একুশ শতকে ইন্টারনেট শিশু-কিশোরদের জন্য খুলে দিয়েছে জ্ঞানের অপার সম্ভাবনা। করোনাকালীন ইন্টারনেটে পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করেছে। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, বিশেষ করে শিশুদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য, অশালীন মন্তব্য, বিব্রতকর ছবি প্রকাশ করার ঘটনা অহরহ ঘটছে, যাকে সাইবার বুলিং বলা হয়, যা বিভিন্ন কারণে শহর ও প্রান্তিক পর্যায়ে চিত্র অনেকটা ভিন্ন।
তেমনই একজন ভুক্তভোগী প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা দশম শ্রেণির ছাত্রী নাফিসা। পড়াশোনায় তুখোড় নাফিসা এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করায় খবরের কাগজে শিরোনামের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশ করে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন।
কিন্তু নাফিসার অর্জনকে ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার বিষয়বস্তু হলো তার মুখের ঘন লোম আর চেহারার গড়ন। সেখানে বিভিন্ন মানুষের লেখা মন্তব্যগুলো কিছুটা এমন—‘এত পড়ালেখা না করে খানিকটা রূপচর্চায় মনোযোগ দিলে এমন দেখতে লাগত না’, ‘ওর মুখে তো আমার থেকেও ভালো দাড়ি গজিয়েছে’। এসব শুনে দমে না গিয়ে নাফিসা স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার। নাফিসা একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ, তবে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা তার মতো বাস্তবে সবাই হয়তো পরিবারের সহযোগিতা পায় না।
তেমনই আরেকজন মফস্বলের কলেজ শিক্ষার্থী রাইয়ান। ছোটবেলা থেকেই নাচ নিয়ে আগ্রহী হওয়ায় স্কুলে বিভিন্ন সময়ে নাচের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেয়েছে। তার অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে রাইয়ানের মা-বাবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলের নামে পেইজ খুলে এগুলো শেয়ার করতেন। ছেলে হয়ে নাচের প্রতি আগ্রহকে কেন্দ্র করে সহপা� ীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাইয়ানের ছবিতে অশালীন ও বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য লিখে ট্রল করতে থাকে, যা তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অভিযোগ নিয়ে তার মা-বাবা ও শিক্ষকদের কাছে তেমন সাড়া পায় না, বরং তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে বলেন। একাকিত্ব ও বুলিংয়ের চাপে রাইয়ান হতাশায় ভুগতে থাকে এবং নাচের প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এসব বুলিং তার পুরো পরিবারের জন্য অসম্মানজনক মনে করে হতাশার একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়।
নাফিসা ও রাইয়ানের মতো বহু শিশু-কিশোর প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিং বা অনলাইনে হয়রানি, অশালীন কিংবা বিব্রতকর মন্তব্য, মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর শিকার হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোট শিশুর প্রায় ৫৯ শতাংশ অনলাইনে অন্তত একধরনের নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শিশুরা জানিয়েছে, তারা সবচেয়ে বেশি যেসব সাইবার নিপীড়নের সম্মুখীন হয় সেগুলো হচ্ছে—বুলিং, উপহাস, গুজব বা অপমান (৩৬ শতাংশ), অসদুদ্দেশ্যে বেনামে যোগাযোগ করা (১৯ শতাংশ), সুস্পষ্ট যৌনবার্তা বা মন্তব্য (২১ শতাংশ) এবং যৌনতাপূর্ণ ছবি বা ভিডিও পাওয়া (১৭ শতাংশ)।
ইউনিসেফ পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৫ শতাংশ) শিশুই ১১ বছর বয়সের আগেই ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে, যা তাদের সাইবার বুলিং ও সহিংসতার মতো ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তবে আশার কথা হলো, বেসরকারি প্রতিষ্� ানের জরিপে দেখা গেছে, ১২ থেকে ১৮ বছরের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস তারা নিজের দক্ষতা, পরিবারের সাহায্য ও শিক্ষকদের পরামর্শের মাধ্যমে এ ধরনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা মোকাবিলা করতে পারবে। তবে গুরুতর সাইবার সহিংসতার ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশে সাইবার সম্পর্কিত সহিংসতা নিরসনে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করা হলেও এই আইনগুলো কতটুকু নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে প্রণীত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৫ ও ২৯ অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে কাউকে আক্রমণ করে, ভয় দেখিয়ে বিরক্ত বা অপমান করার জন্য তথ্য প্রকাশ করলে এবং মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুকে বাধ্য করে বা প্রলোভন দেখিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করলেও তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও আইনটিতে সুনির্দিষ্টভাবে অনলাইনভিত্তিক যৌন হয়রানি সম্পর্কিত কোনো বিধানের উল্লেখ নেই।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে শিশুদের সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষার কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সাইবার বুলিং, প্রতিশোধমূলক পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি অপরাধ প্রায়শই আইনের আওতার বাইরে থেকে যায়। এ ছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রতা, প্রমাণ সংগ্রহের জটিলতা ইত্যাদি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অধিকাংশ মা-বাবা সাইবার বুলিংয়ের ঘটনাগুলো রিপোর্ট করার সাহস পান না। তা ছাড়াও শহর ও প্রান্তিক এলাকায় শিশুদের সাইবার-সংক্রান্ত জটিলতার ভিন্নতা রয়েছে যেমন: শহরাঞ্চলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাইবার বুলিং হয়ে থাকে; অন্যদিকে প্রান্তিক অঞ্চলে ম্যানুয়াল গ্রাফিকস ব্যবহার করে এ ধরনের বুলিং করা হয়, তবে সেখানে অপরাধের প্রভাব প্রখর।
ইন্টারনেট শিশুদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রয়েছে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি। শিশুদের এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সাইবার সেলে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও নাগরিক সংগ� নসমূহ শিশুদের ইন্টারনেট নিরাপত্তা ও ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। ব্লাস্টের উদ্যোগে সংগ� িত ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ প্ল্যাটফরমের সংগ� নসমূহ নিয়মিতভাবে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের আইনি সহায়তা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত সমস্যার তাৎক্ষণিক নিরসনে কাজ করছে।
শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে সাইবার বুলিং ও অনলাইন যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইনি বিধান রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন জরুরি। পাশাপাশি, শিশু ও অভিভাবকদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। সর্বোপরি, নাফিসা ও রাইয়ানের মতো কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে আইনি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও দক্ষ ও সংবেদনশীল করে তোলা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উল্লেখিত নাফিসা ও রাইয়ান চরিত্র দুটি কাল্পনিক।