বাল্যবিবাহ: কিশোর-কিশোরীদের ভূমিকা
Originally posted in আজকের পত্রিকা on 11 July 2024
কয়েক মাস আগে ঢাকার হাজারীবাগের ১৩ বছরের আঁখিকে (ছদ্মনাম) প্রতিবেশী আত্মীয় তাদেরই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আঁখির মা-বাবা রাজি হন না। কিছুদিন পর মা-বাবা যখন আঁখিকে বাড়িতে একা রেখে কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান, সেই সুযোগে ফুসলিয়ে, মিথ্যা বলে, বিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের সেই প্রতিবেশী আত্মীয় তাকে নিয়ে যায় গাজীপুরে।
অনেক খোঁজ করার পর আঁখির মা-বাবা জানতে পারেন, আঁখি কোথায়। তাঁরা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্লাস্ট তাদের একজন আইন সহায়তা কর্মী প্যারালিগ্যাল মো. ওয়ালিউল্লাহকে দায়িত্ব দেয়। ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে প্যারালিগ্যাল ওয়ালিউল্লাহ দ্রুততম সময়ে আঁখির মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং নিকটস্থ থানায় যান। কিন্তু পুলিশ হাজারীবাগ থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। যেহেতু হাজারীবাগ থেকে আঁখিকে নেওয়া হয়েছে। এরপর ব্লাস্ট হেড অফিস থেকে প্যারালিগ্যাল অটল চন্দ্র সরকার হাজারীবাগ থানায় যান এবং আঁখির মা বাবাকে জিডি করতে সহায়তা করেন। জিডির কপি পাওয়ার পর, পুলিশ আঁখিকে উদ্ধারের জন্য তৎপর হয়। অবশেষে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে আঁখিকে উদ্ধার করা হয় এবং তার বাল্যবিবাহ থামানো হয়। আঁখির মতো আরও অনেকেই বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে। তাদের অনেকেই আবার বাল্যবিবাহের হাত থেকে রেহাই পায় না।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছিল তাদের শৈশবে (তথ্যসূত্র: চাইল্ড ম্যারেজ রিপোর্ট বাংলাদেশ ২০২০, ইউনিসেফ)। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগে এবং ১ কোটি ৩ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে।
বাল্যবিবাহ মেয়েদের শৈশব কেড়ে নেয় এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। যে মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়, তাদের পারিবারিক সহিংসতার আশঙ্কা সব থেকে বেশি। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই স্বামীদের দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়। বাল্যবিবাহের ফলে যদি কোনো কিশোরী সন্তানের মা হয়, তার গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেই সন্তানটিও স্বাস্থ্যগত ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরী মেয়েটির সঙ্গে তার সমবয়সী স্কুলপড়ুয়া বন্ধুদের তুলনা করলে দেখা যায়, তার বন্ধুরা স্কুলে যাচ্ছে, খেলছে, পড়ছে, অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখছে। অথচ বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সংসারের কাজ করছে, সন্তান লালনপালন করছে। লেখাপড়া থেকে দূরে থাকার ফলে সে সাধারণ জীবন যাপনের জন্য যে জ্ঞান রাখা দরকার, তা রাখতে পারছে না। তাকে সব সময় নির্ভর হয়ে থাকতে হচ্ছে তার স্বামীর ওপর। শুধু তা-ই নয়, তাকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ থেকে। (তথ্যসূত্র: চাইল্ড ম্যারেজ রিপোর্ট বাংলাদেশ ২০২০, ইউনিসেফ) বাল্যবিবাহ মোকাবিলার জন্য প্রচলিত রয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭। আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, বিয়ের ক্ষেত্রে একটি মেয়ে ১৮ বছর বয়সের কমে বিয়ে করলে এটি একটি অপরাধ এবং ছেলে হলে ২১ বছর বয়সের আগে বিয়ে করা যাবে না। আইন অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ যে করবে, বাল্যবিবাহ যে দেবে এবং তাদের সহযোগী—তিন পক্ষের জন্যই সাজার বিধান রয়েছে। যদি কোনো কাজি বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করেন, তিনিও আসবেন শাস্তির আওতায় এবং সেই কাজির লাইসেন্স বাতিল করার কথাও আইনে উল্লেখ আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাল্যবিবাহ নিরোধে একটি সুস্পষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও দেশে এটি কেন প্রচলিত? এবং এর বিস্তার এত বেশি কেন? মেয়েশিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের নিরাপত্তার অভাববোধ, আইন সম্পর্কে অসচেতনতা, স্থানীয় পর্যায়ে যৌন হয়রানি, মেয়েদের শিক্ষার এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকাই মূলত এই চর্চার জন্য দায়ী। এ ছাড়া বাংলাদেশে বেশির ভাগ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবক বয়সের মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন, কাজিরা বিয়ের ক্ষেত্রে আইনে নির্ধারিত বয়স প্রমাণের নিয়মগুলো মানছেন না, ব্যবহৃত হচ্ছে জন্মনিবন্ধন, শিক্ষা বা জাতীয় পরিচয়পত্রের জাল সনদ। আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও সচেতনতার অভাবে আইন অমান্য করছে বেশির ভাগ মানুষ।
কোভিড-১৯ মহামারি বাল্যবিবাহ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনএফপির একটি পরীক্ষণ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে তথা পুরো বিশ্বেই কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরবর্তী লকডাউন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুদের স্কুলে পড়ানো একটা অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে। আশঙ্কা করা হয়েছিল এর ফলে আয়-উৎপাদনের সুযোগের অভাব আরও বাড়বে। মেয়েশিশু ও কিশোরীদের নিয়ে মা-বাবার নিরাপত্তাহীনতা কোভিড মহামারিতে আরও বেড়ে যায়, ফলে বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বাড়ে। অসংখ্য মেয়েশিশু ও কিশোরী পড়ে যায় বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে কিশোর-কিশোরী, তাদের মা-বাবা ও অভিভাবক এবং সমাজে বসবাসরত সবার মাঝেই আইনি সচেতনতা বাড়াতে হবে, পেতে হবে তাদের অধিকার, দায়িত্ব, প্রতিকার এবং সেবা সম্পর্কে তথ্য। বাল্যবিবাহ হয়ে গেলে পরবর্তী আইনি প্রতিকারগুলো, বিশেষ করে সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। বাল্যবিবাহের ফলে ক্ষতির শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। তারা যেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে, বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে যাওয়ার আগে মা-বাবাকে বোঝাতে পারে যে তাদের সামনে নিজেদের গড়ে তোলার আরও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, সে জন্য তাদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনি সচেতনতা দিতে হবে। নিজেদের ভেতর নেতৃত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ গড়ে উ� লে বাল্যবিবাহ বন্ধে এই কিশোর-কিশোরীরাই এগিয়ে আসতে পারবে, নিজেদের মত প্রকাশ করতে সাহস পাবে, প্রতিবাদ করতে পারবে। সেই সঙ্গে তারা অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সহযোগিতায় নিজেদের এবং অন্যদের জন্য বাল্যবিবাহের ঝুঁকি কমাতে কাজ করতে পারবে।
প্রমা ইসরাত, প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, জেন্ডার জাস্টিস ও নারীর ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট